লিভার

Share This Post

লিভার কি?

লিভার আমাদের দেহের একটি বড় অঙ্গ যা প্রতিনিয়ত একটি ফ্যাক্টরি বা কারখানার ন্যায় কাজ করে এবং আমাদের শরীরে গৃহীত বিভিন্ন খাদ্য উপাদান বিপাকের মাধ্যমে কিছু অংশ গুদামজাত করে এবং কিছু প্রয়োজনীয় অংশ শরীরের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দিয়ে দেহের ক্ষয়পূরণ, গঠন ও বৃদ্ধির কাজ করে ; গৃহীত ওষুধ লিভার হতে তৈরি অ্যালবুমিন নামক অতি গুরুত্বপূর্ণ পদার্থের সাথে বন্ধন তৈরি করে শরীরের বিভিন্ন ক্ষতস্থানে পৌঁছে দেয়; বিষাক্ত পদার্থকে ডিটক্সিফাই অর্থাৎ নির্বিষ করে দেহ থেকে নিষ্কাশন করে রোগ জীবাণু ধ্বংসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

অন্যদিকে লিভারের পুনর্জন্ম ক্ষমতা বেশি, তাই লিভার সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত লক্ষ্মণ উপসর্গ প্রকাশ পায় না… এমনকি লিভারের মাত্র ১৫ শতাংশ কোষ বেঁচে থাকলেও লিভার তার স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে পারে।

লিভারের কাজ কি?

১) গৃহীত খাবারের বিপাক, প্রসেস,  মজুদ করে এবং প্রয়োজনীয় অংশ শরীরের ক্ষয়পূরণ, গঠন, বৃদ্ধি ও চালিকাশক্তিতে কাজে লাগায়,

২) গৃহীত খাবারের সাথে আগত বিভিন্ন রাসায়নিক, বিষাক্ত পদার্থ নির্বিষ করে,

৩) গৃহীত ওষুধ প্রসেস করে দূরবর্তী ক্ষতস্থানে প্রেরণ করে এবং রোগ নিরাময় করে,

৪) দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় ব্যাপকভিত্তিক ভূমিকা পালন করে।

লিভার এর কাজ কি?

লিভারের রোগসমূহঃ

(১) হেপাটাইটিস

★ হেপাটাইটিস এ ভাইরাস ইনফেকশন (HAV Infection)

★ হেপাটাইটিস ই ভাইরাস ইনফেকশন (HEV Infection)

★ হেপাটাইটিস বি ভাইরাস ইনফেকশন (HBV Infection)

★ হেপাটাইটিস সি ভাইরাস ইনফেকশন (HCV Infection)

★ ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া জনিত হেপাটাইটিস (Drug induced hepatitis – DILI)

★ মদ্যপান জনিত হেপাটাইটিস (Alcoholic hepatitis)

★ অটোইমিউন হেপাটাইটিস (Autoimmune hepatitis)

(২) ফ্যাটি লিভার (MAFLD)

(৩) নন-অ্যালকোহলিক স্টিয়াটো হেপাটাইটিস (NASH)

(৪) লিভার সিরোসিস

(৫) লিভার টিউমার ও ক্যান্সার

(৬) লিভার সিস্ট

(৭) লিভারের পাথর (Hepatolithiasis)

(৮) হিমোক্রোম্যাটোসিস

(৯) উইলসন’স ডিজিজ

(১০) গিলবার্ট’স সিন্ড্রোম

হেপাটাইটিস এ ও ই

হেপাটাইটিস এ ও ই কি?

অবিশুদ্ধ পানি ও খাদ্যদ্রব্যের মাধ্যমে এই ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করে লিভারের ইনফেকশন বা প্রদাহ তৈরি করে।

প্রতিরোধের উপায়ঃ

বিশুদ্ধ পানি, পানীয় ও টাটকা খাবার গ্রহণ করা। স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা।

করণীয় কি?

সাধারণত কোন ওষুধের প্রয়োজন পড়ে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে লিভারের কার্যক্ষমতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেতে পারে (Acute liver failure), তাই একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ লিভার বিশেষজ্ঞের পরামর্শে চিকিৎসা নেওয়াই শ্রেয়।

হেপাটাইটিস বি ও সি

হেপাটাইটিস বি ও সি কি?

হেপাটাইটিস বি ভাইরাস সংক্রমণের ফলে লিভারের যে ইনফেকশন (হেপাটাইটিস) বা প্রদাহ হয় তাকে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস জনিত হেপাটাইটিস বলে।

হেপাটাইটিস সি ভাইরাস সংক্রমণের ফলে যে ইনফেকশন (হেপাটাইটিস) বা প্রদাহ হয় তাকে হেপাটাইটিস সি ভাইরাস জনিত হেপাটাইটিস বলে।

হেপাটাইটিস বি ও সি | Hepatitis B Treatment | Hepatitis C Treatment

প্রতিরোধের উপায়ঃ

হেপাটাইটিস বি ভাইরাস প্রতিরোধী ভ্যাকসিন বা টিকা নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

হেপাটাইটিস সি এর কোন টিকা নেই, ব্যক্তিগত প্রতিরোধই একমাত্র উপায়।

করণীয় কি?

দক্ষ ও অভিজ্ঞ লিভার বিশেষজ্ঞের পরামর্শে যথাযথ চিকিৎসা নিতে হবে।

লিভার সিরোসিস

লিভার সিরোসিস কি?

দীর্ঘ মেয়াদী প্রদাহ জনিত (Hepatitis) কারণে লিভারের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ফাইব্রোটিক টিস্যু এবং একই সাথে গুটি (Regenerating nodules) তৈরি হয়ে লিভারের মসৃণ আকার আকৃতি লোপ পেয়ে এবড়োখেবড়ো কদাকার আকৃতি ধারণ করা এবং এর কার্যক্ষমতার ব্যাপক হ্রাস পাওয়াই হলো লিভার সিরোসিস।

প্রতিরোধের উপায়ঃ

হেপাটাইটিস বি, সি ও ফ্যাটি লিভারের প্রতিরোধ, মাদক ও মদ্যপান বর্জন এবং অন্যান্য যে সকল কারণে হেপাটাইটিস হয় তার সর্বাত্মক প্রতিরোধ লিভার সিরোসিসের প্রকোপ কমায়।

লিভার সিরোসিস কতটা মারাত্মক হতে পারে। -ডা. এম. সাঈদুল হক

করণীয় কি?

বিভিন্ন ধরনের লিভার সহায়ক চিকিৎসা নিতে হয়। কিছু জটিল অবস্থায় ইন্টারভেনশনাল চিকিৎসা এবং সার্জারিরও প্রয়োজন হয়। লিভার প্রতিস্থাপন (Liver transplantation) কিছু কিছু ক্ষেত্রে দীর্ঘায়ু লাভে সহায়তা করে।

লিভার টিউমার ও ক্যান্সার

লিভার টিউমার ও ক্যান্সার কি?

লিভারে অক্ষতিকর সাধারণ টিউমার (Benign tumour) এবং ক্ষতিকর ক্যান্সার (Malignant tumour) উভয় ধরনের টিউমার হতে পারে। লিভারের নিজস্ব ক্যান্সারের (Primary Hepatocellular Carcinoma) তুলনায় দেহের অন্য অঙ্গ থেকে আগত ক্যান্সার (Metastatic Carcinoma) বেশি হয়ে থাকে।

প্রতিরোধের উপায়ঃ

হেপাটাইটিস বি, সি, ফ্যাটি লিভার এবং সিরোসিস প্রতিরোধের মাধ্যমে লিভার ক্যান্সারের প্রকোপ কমানো যেতে পারে।

করণীয় কি?

আকারে ছোট থাকলে টিউমারসহ লিভারের অংশের অপসারণ (Resection), আরএফএ (Radio Frequency Ablation), লিভার টিউমারের সুনির্দিষ্ট অংশে কেমোথেরাপি বা TACE (Transarterial chemoembolization), এবং কোন কোন ক্ষেত্রে লিভার প্রতিস্থাপন (Liver transplantation) করা যেতে পারে।

হেপাটাইটিস বি (Hepatitis B)

হেপাটাইটিস বি কি?

হেপাটাইটিস বি ভাইরাসজনিত কারণে লিভারে যে প্রদাহের সৃষ্টি হয় তাকে বি ভাইরাসজনিত হেপাটাইটিস (হেপাটাইটিস বি) বলে।

হেপাটাইটিস বি কি কি ধরনের হয়?

(১) Acute hepatitis বা স্বল্প মেয়াদি হেপাটাইটিসঃ

এই রোগ অনধিক ৬ মাস ব্যাপী স্থায়ী হতে পারে এবং সাধারণত ৪-৬ সপ্তাহের মধ্যে সেরে যায়।

(২) Chronic hepatitis বা দীর্ঘ মেয়াদি হেপাটাইটিসঃ

এই ধরনের হেপাটাইটিস সাধারণত ৬ মাসের বেশি স্থায়ী হয় এবং কয়েক বছর এমনকি কয়েক দশক ব্যাপী স্থায়ী হতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদি হেপাটাইটিস লিভার সিরোসিসের অন্যতম প্রধান কারণ।

হেপাটাইটিস বি এর উপসর্গসমূহঃ

একিউট হেপাটাইটিসঃ এ ক্ষেত্রে ক্ষুধামন্দা বা খাওয়ায় অরুচি, বমি কিংবা বমি বমি ভাব, শারীরিক দুর্বলতা, জ্বর কিংবা জ্বর জ্বর ভাব, শরীর ব্যথা, অস্থিসন্ধি ব্যথা, পেটের উপরিভাগে ডান দিকে ব্যথা এবং একই সঙ্গে চোখের ও প্রস্রাবের রং হলুদ হয়ে জন্ডিস দেখা দিতে পারে।

ক্রনিক হেপাটাইটিসঃ আক্রান্ত রোগীর কোন উপসর্গ না-ও থাকতে পারে। এই রোগের সুপ্তাবস্থা (ভাইরাস সংক্রমণ থেকে রোগের লক্ষ্মণ প্রকাশ পাওয়া পর্যন্ত) প্রায় ৪-৬ মাস। ফ্লু-এর মতো জ্বর, ক্লান্তিবোধ, শরীর টনটন করা, ব্যথা, বমি ভাব এবং ক্ষুধামন্দা – এই রোগের লক্ষ্মণ।

ঝুঁকিতে আছেন যারাঃ

★ রোগাক্রান্ত মায়ের নবজাতকেরা

★ ইনজেকশনের মাধ্যমে নেশা গ্রহণকারী

★ রোগাক্রান্তের পরিবারের ঘনিষ্ঠজনেরা এবং তার সঙ্গী বা সঙ্গিনী

★ স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত কর্মী যারা রক্তের সংস্পর্শে প্রায়শই আসেন যেমন – শল্য চিকিৎসক, ডায়ালাইসিস ইউনিট ও রক্ত পরিসঞ্চালন (Blood transfusion) বিভাগের কর্মীরা, দাঁতের ডাক্তার, সেবিকা এবং ধাত্রীগণ।

কিভাবে এই রোগ ছড়ায়ঃ-

১) রক্তের সংস্পর্শতাঃ

নিরীক্ষাবিহীন (Unscreened) রক্ত বা রক্তের উপাদান পরিসঞ্চালন, সংক্রমিত রক্ত – কাটা জায়গার সংস্পর্শে আসলে, খোলা ক্ষত স্থান অথবা আঁচড়ের সংস্পর্শে আসলে।

২) দূষিত যন্ত্রপাতির ব্যবহারঃ

বিভিন্ন রকম চিকিৎসায় (মেডিকেল ও ডেন্টাল) দূষিত যন্ত্রপাতির ব্যবহার।

৩) মায়ের কাছ থেকে নবজাতকেঃ

আক্রান্ত মায়ের কাছ থেকে নবজাতকের হেপাটাইটিস বি সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে। বিশেষ করে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস আক্রান্ত গর্ভবতী মায়ের রক্তে যাদের হেপাটাইটিস বি এর ই অ্যান্টিজেন (HBeAg) রয়েছে তাদের নবজাতকের শরীরে শতকরা ৯০ ভাগ সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

৪) ইনজেকশনের মাধ্যমে নেশাগ্রহণঃ

একই সূঁচ বিভিন্ন জনের ব্যবহারে শতকরা ৪০ থেকে ৮০ ভাগ নেশাগ্রহণকারী হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে।

৫) ব্যক্তিগত জিনিসের মাধ্যমেঃ

ব্যক্তিগত দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিস যেমন – দাতঁ ব্রাশ, শেভিং রেজার একাধিক ব্যক্তির ব্যবহার।

৬) আকুপাংচার, উল্কি আঁকা বা ট্যাটু এবং শরীরের বিভিন্ন অংশ ছিদ্র করার মাধ্যমেঃ

দূষিত যন্ত্রপাতি দ্বারা আকুপাংচার, ট্যাটু বা নাক-কান ফোড়ানোর কাজে কেউ কেউ এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হতে পারেন। চুল কাটা ও শেভ করার জন্য সেলুনে, হাটে বাজারে একই ক্ষুর বিভিন্ন জনকে ব্যবহার করার মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে।

৭) লালারস দ্বারাঃ

লালারসে এই ভাইরাসের অস্তিত্ব সনাক্ত করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে চুম্বনের মাধ্যমে এই ভাইরাস সংক্রমিত হতে পারে।

৮) অরক্ষিত যৌনকর্মের মাধ্যমেঃ

কোন প্রকার সুরক্ষা সামগ্রী ছাড়া যৌনকর্মের মাধ্যমে এই ভাইরাসের সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

কিভাবে এই রোগ প্রতিরোধ করা যায়ঃ

১) ব্যক্তিগত পদক্ষেপঃ

★ ব্যক্তিগত ব্যবহার্য দ্রব্যাদির সহব্যবহার পরিহার করা,

★ একবার ব্যবহার্য (One time use, Disposable) সিরিঞ্জ, সূঁচ ও সুতা ব্যবহার করা ;

★ নিরাপদ (Screened) রক্ত পরিসঞ্চালন প্রবর্তন করা,

★ জীবাণুমুক্ত মেডিক্যাল, ইন্টারভেনশনাল, সার্জিক্যাল ও ডেন্টাল যন্ত্রপাতির ব্যবহারের প্রচলন করা ;

★ নিরাপদ যৌন চর্চা করা।

২) ভ্যাকসিনেশন বা টিকা গ্রহণের মাধ্যমেঃ

নির্দিষ্ট নিয়মে টিকা গ্রহণের মাধ্যমে হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধ করা সম্ভব।  আর টিকা গ্রহণের পূর্বে অবশ্যই হেপাটাইটিস বি স্ক্রিনিং করে নিতে হবে।

হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের ওষুধ কতদিন খেতে হবে?

টিকা নেওয়ার নিয়মঃ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর পরামর্শ অনুযায়ী এই টিকা নিতে হবে –

০, ১, ৬  অথবা ০, ১, ২ ও ১২ মাসে।  যদি কাঙ্খিত টাইটার অর্জিত না হয়, তবে ৩য় ডোজের পর অতিরিক্ত আরও একটি ডোজ (বুস্টার ডোজ) নিতে হবে।

টিকার কার্যকরিতাঃ

সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে ৮৫-১০০ ভাগ অ্যান্টিবডি প্রস্তুত করার ক্ষমতা (অ্যান্টিবডি রেসপন্স) দেখা যায়। টিকা দেওয়ার ১ থেকে ৩ মাসের মধ্যে  অ্যান্টিবডি টেস্ট করে টাইটার (Anti-HBs) দেখতে হয়। Anti-HBs ১০০ ইউনিট হলে ভালো হয়, ১০-১০০ ইউনিট হলে মোটামুটি এবং ১০ ইউনিট এর কম হলে অতিরিক্ত আরও একটি ডোজ (বুস্টার ডোজ) নিতে হবে।

হেপাটাইটিস বি (HBsAg Positive) রোগীদের করণীয়ঃ

হেপাটাইটিস বি পজিটিভ রোগীদের অহেতুক ঘাবড়ানোর কারণ নেই। তবে জেনে নিতে হবে যে, হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের কারণে লিভারে কোন ক্ষতি হয়েছে কি না অথবা হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না। এর জন্য অন্যান্য পরীক্ষা করে নিতে হবে, যেমন – রক্তে HBeAg, Anti-HBe, Anti-HBs, HBV-DNA (PCR), SGPT, AFP, USG of W/A, Fibroscan of liver এবং Endoscopy of UGIT.

এই সমস্ত পরীক্ষার ফলাফল এবং রোগীর শারীরিক উপসর্গ বিবেচনা করে উপযুক্ত চিকিৎসা নির্ধারণ করতে হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা আরম্ভ করতে হয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রীতিমতো ফলোআপে রাখতে হয়, যাতে প্রাথমিক অবস্থায় সঠিক চিকিৎসা শুরু করা যায়।

অপরদিকে পরিবারের সবাইকে হেপাটাইটিস বি স্ক্রিনিং পরীক্ষা করে এবং তদনুযায়ী (নেগেটিভদের) ভ্যাকসিন বা টিকা দেওয়া বাঞ্ছনীয়।

হেপাটাইটিস সি

হেপাটাইটিস সি কি?

হেপাটাইটিস সি ভাইরাসজনিত কারণে লিভারে যে প্রদাহের সৃষ্টি হয় তাকে সি ভাইরাসজনিত হেপাটাইটিস (হেপাটাইটিস সি) বলে।

হেপাটাইটিস সি কি কি ধরনের হয়?

১) একিউট বা স্বল্প মেয়াদি হেপাটাইটিসঃ

এই রোগ সাধারণত কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাসের মধ্যে এবং অনধিক ৬ মাসের মধ্যে সেরে যায়।

২) ক্রনিক বা দীর্ঘ মেয়াদি হেপাটাইটিসঃ

এই ধরনের হেপাটাইটিস সাধারণত ৬ মাসের বেশি স্থায়ী হয়। দীর্ঘ মেয়াদি হেপাটাইটিস লিভার সিরোসিসের অন্যতম প্রধান কারণ।

হেপাটাইটিস সি এর লক্ষ্মণ উপসর্গসমূহঃ

আক্রান্ত রোগীর কোন উপসর্গ না-ও থাকতে পারে। এই রোগের সুপ্তাবস্থা (ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রোগের লক্ষ্মণ প্রকাশ পর্যন্ত) প্রায় ৪ সপ্তাহ থেকে ৬ মাস। এক্ষেত্রে ফ্লু-এর মতো জ্বর, ক্লান্তিবোধ, শরীর টনটন করা, ব্যথা, বমি ভাব এবং ক্ষুধামন্দা দেখা দিতে পারে।

ঝুঁকিতে আছেন যারাঃ

★ রোগাক্রান্ত মায়ের নবজাতকেরা,

★ ইনজেকশনের মাধ্যমে নেশাগ্রহণকারী,

★ রোগাক্রান্তের পরিবারের ঘনিষ্ঠজনেরা এবং তার সঙ্গী বা সঙ্গিনী,

★ স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত কর্মীরা যারা রক্তের সংস্পর্শে প্রায়শই আসেন, যেমন – শল্য চিকিৎসক, ডায়ালাইসিস ইউনিট ও রক্ত পরিসঞ্চালন (Blood transfusion) বিভাগের কর্মীরা, দাঁতের ডাক্তার, সেবিকা এবং ধাত্রীগণ।

কিভাবে এই রোগ ছড়ায়ঃ

১) রক্তের সংস্পর্শতাঃ

নিরীক্ষাবিহীন (Unscreened) রক্ত বা রক্তের উপাদান পরিসঞ্চালন, সংক্রমিত রক্ত – কাটা জায়গার সংস্পর্শে আসলে, খোলা ক্ষত স্থান অথবা আঁচড়ের সংস্পর্শে আসলে।

২) দূষিত যন্ত্রপাতির ব্যবহারঃ

বিভিন্ন রকমের চিকিৎসায় (মেডিকেল, ইন্টারভেনশনাল, সার্জিক্যাল, ডেন্টাল) দূষিত যন্ত্রপাতির ব্যবহার।

৩) মায়ের কাছে থেকে নবজাতকেরঃ

আক্রান্ত মায়ের কাছ থেকে নবজাতকের হেপাটাইটিস সি সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে। বিশেষ করে হেপাটাইটিস সি ভাইরাস আক্রান্ত গর্ভবতী মায়ের থেকে তাদের নবজাতকের শরীরে সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

 ৪) ইনজেকশনের মাধ্যমে নেশাগ্রহণঃ

একই সূঁচ বিভিন্ন জনের ব্যবহারে শতকরা ৮০ ভাগ নেশা গ্রহণকারী হেপাটাইটিস সি ভাইরাসে সংক্রামিত হতে পারে।

৫) ব্যক্তিগত জিনিসের মাধ্যমেঃ

ব্যক্তিগত দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিস যেমন – দাঁত ব্রাশ, শেভিং রেজার একাধিক ব্যক্তির ব্যবহার।

৬) লালারস দ্বারাঃ

লালারসে এই ভাইরাসের অস্তিত্ব সনাক্ত করা হয়েছে। চুম্বনের মাধ্যমে এই ভাইরাস সংক্রমিত হতে পারে।

৭) আকুপাংচার, উল্কি আঁকা বা ট্যাটু এবং শরীরের বিভিন্ন অংশ ছিদ্র করার মাধ্যমেঃ

দূষিত যন্ত্রপাতি দ্বারা আকুপাংচার, ট্যাটু বা নাক-কান ফোড়ানোর সকল কিছু সংখ্যক ব্যক্তি এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হতে পারেন। চুল কাটা ও শেভ করার জন্য সেলুনে, হাটে বাজারে একই ক্ষুর বিভিন্ন জন ব্যবহার করার মাধ্যমে এটা ছড়াতে পারে।

৮) অরক্ষিত যৌন মিলনের মাধ্যমেঃ

যদিও যৌনকর্মের দ্বারা এই ভাইরাসের সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ তথাপি কদাচিৎ হতে পারে।

৯) মাতৃদুগ্ধ পানেঃ

যদি মায়ের মধ্যে রোগের কোন উপসর্গ বা থাকে তবে সেই দুধ নিরাপদ। কিন্তু তাত্ত্বিকভাবে এই রোগের বিস্তার সম্ভব, যদি মায়ের নিপল ফেটে (Crack nipple) সেখান থেকে রক্ত ঝরে আর বাচ্চার মুখে ক্ষত থাকে।

হেপাটাইটিস সি এর চিকিৎসা 

কিভাবে এই রোগ প্রতিরোধ করা যায়ঃ

ব্যক্তিগত পদক্ষেপ –

★ ব্যক্তিগত দ্রব্যাদির সহব্যবহার পরিহার করা,

★ একবার ব্যবহার্য (One time use, Disposable) সিরিঞ্জ, সূঁচ ও সুতা ব্যবহার করা,

★ নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালনের প্রবর্তন করা,

★ নিরাপদ যৌন চর্চা

হেপাটাইটিস সি পজিটিভ (HCV Positive) রোগীদের করণীয়ঃ

রোগী যদি হেপাটাইটিস সি পজিটিভ হন তাহলে, লিভারের কার্যকারিতা নির্ণয়ের জন্য লিভার ফাংশন টেস্ট (LFT) ও সংক্রমণের পর্যায় জানার জন্য HCV-RNA(PCR) টেস্ট করতে হয়। এবং সাথে AFP, USG of W/A, Fibroscan of liver, Endoscopy of UGIT করে নিতে হয়।

হেপাটাইটিস সি ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের নিয়মিত লিভার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে ফলোআপে থাকতে হয়, যাতে লিভারের অবস্থা সঠিকভাবে নিরূপণ করে ঠিক সময়ে উপযুক্ত চিকিৎসা করা যায়। লিভার কোষ ধ্বংসের গতি বন্ধ এবং শরীরকে ভাইরাস মুক্ত করার জন্য কার্যকরী চিকিৎসা নেওয়া যেতে পারে যা কিছুটা ব্যয়বহুল।

হেপাটাইটিস সি ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের রক্ত প্রদান, অঙ্গ প্রদান, কর্ণিয়া প্রদান ও সেলুনে কিংবা হাটে বাজারে শেভ করা থেকে বিরত থাকা উচিত, যাতে আক্রান্ত রোগীর রক্তের মাধ্যমে এই রোগের বিস্তার না ঘটে।

লিভার ভালো রাখার উপায়

★ রাস্তার পাশের স্ট্রিট ফুড বা খোলা জায়গায় বিক্রিত খাবার থেকে বিরত থাকা,

★ নাক-কান ফোড়ানো, শরীরে ট্যাটু বা উল্কি আঁকা, বহুব্যবহৃত সূঁচ, সিরিঞ্জ, সুতা বা সেলুনে ব্যবহৃত ব্লেড বা ক্ষুর ব্যবহারে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।

★ হেপাটাইটিস বি ভাইরাস প্রতিরোধী টিকা নিতে হবে।

★ নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালনের প্রবর্তন করা,

★ প্রত্যহ নিয়মিত শারীরিক ব্যয়াম করা,

লিভার ভালো রাখার উপায় – ডাঃ এম. সাঈদুল হক

★ পরিমিত বিশুদ্ধ ও সুষম খাবার গ্রহণ করা যেমন, তাজা এবং অল্প রান্না করা সবজি ; মনে রাখতে হবে সবুজ পাতাযুক্ত সবজি, হলুদ কমলা লাল এবং বেগুনি রং এর ফল লিভারের জন্য জন্য বিশেষ উপকারী।

★ অধিক পরিমাণে পানি (দৈনিক ৬-১২ গ্লাস) পান করা প্রয়োজন, কেননা লিভারে খাদ্যের বিপাক ক্রিয়ার ফলে যে বিষাক্ত পদার্থ তৈরি হয় পানি তা কিডনির মাধ্যমে শরীর থেকে বের করে দিতে সাহায্য করে।

★ কোমল পানীয়, মিষ্টি, ফাস্ট ফুড, প্রসেসড ফুড, বাজে তেল ও অধিক শর্করাযুক্ত খাবার পরিহার করতে পারলেই ভালো।

★ প্রসেসড ফুড যেমন পাউরুটি, কেক, পেস্ট্রি, বিস্কুট, লজেন্স, সেরিয়ালস ইত্যাদি কম খাওয়া ভালো।

★ দৈনিক ২-৩ কাপের বেশি চা বা কফি খাওয়া উচিত নয়।

★ ধূমপান, মদ্যপান, খাবারের কৃত্রিম রং ও সুগন্ধিকারক, প্রিজারভেটিভ, অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ ও নেশাজাতীয় দ্রব্য সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাজ্য।

★ মেয়াদোত্তীর্ণ বোতলজাত ও টিনজাত খাবার ও পানীয় বর্জন করা,

★ নিরাপদ যৌন চর্চায় অভ্যস্ত হওয়া,

★ ৪০ বছর বয়সের ঊর্ধ্বে সবাইকে আলট্রাসনোগ্রাফি (Ultrasonography) করে দেখে নিতে হবে – লিভার, গলব্লাডার, বাইল ডাক্ট ও প্যানক্রিয়াসে কোন উপসর্গবিহীন টিউমার বা চাকা আছে কি না।

ডাঃ এম সাঈদুল হক

সহকারী অধ্যাপক, লিভার বিভাগ,

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

চীফ কনসালট্যান্ট, ঢাকা গ্যাস্ট্রো-লিভার সেন্টার।

০১৭০৩-৭২৮৬০১, ০১৭১০-০৩২১৫৮

০১৯২৭-০৬৮১৩৬, ০১৮৬৫-৫০৪০২৬

Subscribe To Our Newsletter

Get updates and learn from the best

More To Explore

আলসারেটিভ কোলাইটিস, কোলোরেকটাল ক্যান্সার, কোলোরেকটাল ক্যান্সার, কোলন ক্যান্সার
লিভার

আলসারেটিভ কোলাইটিস থেকে মরণব্যাধি কোলন ক্যান্সার

আলসারেটিভ কোলাইটিস থেকে হতে পারে মরণব্যাধি কোলন ক্যান্সার আলসারেটিভ কোলাইটিস যথাযথভাবে চিকিৎসা করা না হলে কোলোরেকটাল ক্যান্সার হয়ে প্রতি ৬ জনের একজন মৃত্যুবরণ করতে পারে।

হায়াটাস হার্নিয়া কি কঠিন কোন রোগ?
অন্যান্য

হায়াটাস হার্নিয়া কি কঠিন কোন রোগ?

হায়াটাস হার্নিয়া হলো যখন ডায়াফ্রাম বা মধ্যচ্ছদা’র মাংসপেশীর দুর্বলতার কারণে পাকস্থলীর অংশবিশেষ বুকের দিকে উঠে আসে। ফলশ্রুতিতে এসিড রিফ্লাক্স হয়ে বুক জ্বালাপোড়ার সমস্যা দেখা দেয়।