এটা দীর্ঘ মেয়াদি প্রদাহ জনিত বৃহদান্ত্র বা কোলনের রোগ যা কখনও বাড়ে কখনও ভালো থাকে এবং সাধারণত বছর ব্যাপী স্থায়ী হয়। এটা শুধু মাত্র কোলনের ভিতরের দিকের আবরণী বা মিউকোসাকে আক্রান্ত করে।
★ যে কোন বয়সে হতে পারে
★ পুরুষ এবং মহিলা উভয়ই সমানুপাতিক হারে আক্রান্ত হতে পারেন
★ জনসংখ্যার একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষ এতে আক্রান্ত হয়ে থাকেন
★ যে কোন জাতিগত সম্প্রদায়ের মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন
★ জিনগত ত্রুটি – HLA-DR*103, colonic epithelial barrier function (HNF4, LAMB1, CDH1)
★ ঝুঁকি বেশি যাদের – অধূমপায়ী কিংবা প্রাক্তন ধূমপায়ী ব্যক্তি বেশি আক্রান্ত হতে পারেন, অ্যাপেন্ডিসেকটমি এই রোগ প্রতিরোধ করে।
★ কমেনসেল উপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় (ডিসবায়োসিস)
★ শুধু মাত্র মলাশয় (রেকটাম) এবং বৃহদান্ত্র (কোলন) আক্রান্ত হয়; শুরু হয় পায়ুপথ ও মলাশয়ের সংযোগ স্থল (অ্যানো-রেকটাল মার্জিন) থেকে এবং পরবর্তীতে পুরো কোলনকে আক্রান্ত করে।
★ কোলন ব্যাতীত অন্য অঙ্গে প্রকাশ-
* চোখ – কনজাংটিভাইটিস, আইরাইটিস, এপিস্ক্লেরাইটিস
* মুখে – আলসার বা ঘা
* লিভার – ফ্যাটি লিভার, অটোইমিউন হেপাটাইটিস, লিভার অ্যাবসেস, পোর্টাল পায়েমিয়া
* পিত্ত থলিতে – গল স্টোন বা পাথর
* পিত্ত নালীতে – প্রাইমারি স্ক্লেরোজিং কোলেনজাইটিস, কোলান্জিওকারসিনোমা
* মেসেনটারিক কিংবা পোর্টাল ভেইন থ্রম্বোসিস
* কিডনি – অ্যামাইলয়েডোসিস, অক্সালেট পাথর
* স্যাক্রোআইলিআইটিস/অ্যানকাইলোজিং স্পন্ডালাইটিস
* ভেনাস থ্রম্বোসিস
* মেটাবলিক বোন ডিজিজ
* আর্থ্রাইটিস
* ইরাইথিমা নডোসাম
* পায়োডার্মা গাংগ্রিনোসাম
★ ব্লাডি ডায়েরিয়া বা রক্ত আমাশয়
★ হিস্টোপ্যাথলজি – প্রদাহ শুধু মাত্র মিউকাস আবরণী পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে; ক্রিপ্ট ডিসটরশন, ক্রিপ্টাইটিস, ক্রিপ্ট অ্যাবসেস, গবলিট কোষ না থাকা
★ চিকিৎসা – ৫-অ্যামাইনোস্যালিসাইলিক অ্যাসিড, গ্লুকোকর্টিকয়েড, অ্যাজাথাইয়োপ্রিন, বায়োলজিক থেরাপি, কোলেকটমি (কিউরেটিভ চিকিৎসা)
এই রোগটি অধিক হারে দেখা যায় উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ এবং ওশেনিয়া এলাকায়, কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে পশ্চিমা ধাঁচের জীবন ধারায় অভ্যস্ত হওয়াতে এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার নব শিল্পায়িত দেশগুলোতে এই রোগের দ্রুত বিস্তৃতি ঘটছে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই রোগটি জীবনের ২য় কিংবা ৩য় দশকে শুরু হয় এবং কিছু ক্ষেত্রে ৭ম দশকেও দেখা দিতে পারে।
সাধারণ মানুষের মতোই এই রোগীরা আয়ুষ্কাল লাভ করেন। যদিও অনেক রোগীর সার্জারি কিংবা অন্য অনেক আনুষঙ্গিক সমস্যার জন্য হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন পড়ে তথাপি এঁদের অনেকেই চমৎকার কর্মদক্ষতা দেখাতে পারেন এবং স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন।
আলসারেটিভ কোলাইটিস এ মলাশয় আক্রান্ত হবেই (প্রক্টাইটিস) এবং আরও অগ্রসর হয়ে পুরো কোলনকে আক্রান্ত করে ফেলে অর্থাৎ প্যানকোলাইটিস হয়।
১) প্রোক্টাইটিস ৪০-৫০%
২) লেফ্ট সাইডেড কোলাইটিস ৩০-৪০%
৩) এক্সটেনসিভ কোলাইটিস (প্যানকোলাইটিস) ২০%
দীর্ঘমেয়াদি প্যানকোলাইটিস থাকলে কোলনের দৈর্ঘ্য কমে আসে এবং পোস্ট-ইনফ্লামেটরি সিইডোপলিপ তৈরি করে।
প্রদাহ জনিত সমস্যা কোলোনের ভিতরের দিকের আবরণী বা মিউকোসা পর্যন্ত সীমিত থাকে এবং অন্যস্তরগুলোকে আক্রান্ত করে না। অ্যাকিউট এবং ক্রনিক উভয় প্রদাহ জনিত কোষগুলো ল্যামিনা প্রপ্রিয়া এবং ক্রিপ্টকে আক্রান্ত করে যাকে ক্রিপটাইটিস বলে। অনেক ক্রিপ্ট অ্যাবসেস পাওয়া যায়। মিউকোসা থেকে গবলেট সেল হারিয়ে যায় এবং গ্ল্যান্ডগুলো নষ্ট হয়ে যায়।
ক্রিপ্টের ভেতর ডিসপ্লাসিয়া, নিউক্লিয়ার এটাইপিয়া এবং মাইটোটিক রেট বেড়ে যাওয়ার কারণে কোলন ক্যান্সারের আবির্ভাব ঘটে।
লক্ষ্মণ উপসর্গঃ
প্রধানত পায়ুপথে রক্তপাত সেই সাথে মিউকাস ও রক্ত আমাশয়।
রোগের প্রকাশ নির্ভর করে কোলনের কোন জায়গাটি আক্রান্ত হয়েছে, রোগের বিস্তৃতি এবং অন্য অঙ্গ আক্রান্ত হয়েছে কি না তার উপর।
আক্রান্ত হওয়ার শুরুর দিকে লক্ষ্মণ উপসর্গগুলো মারাত্মক হয় এবং পরবর্তীতে রোগের বাড়তি কমতির মাঝেই থাকে।
মানসিক চাপ, ইনফেকশন, গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস, অ্যান্টিবায়োটিক কিংবা NSAIDs জাতীয় ব্যথা নাশক ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় এই রোগের পুনর্জাগরণ ঘটে।
প্রোক্টাইটিসের ফলে পায়ুপথে রক্তপাত, মিউকাস নিঃসরণ এবং ঘন ঘন মলত্যাগের অনুভূতি জাগে।
কেউ কেউ ঘন ঘন স্বল্প পরিমাণে পাতলা পায়খানা করেন আবার কেউ কেউ গুটি গুটি শক্ত মলত্যাগ করেন। পুরো শরীরে এর প্রতিক্রিয়া খুব কমই দেখা যায়।
লেফট সাইডেড এবং এক্সটেনসিভ কোলাইটিসে রক্ত আমাশয়ের সাথে মিউকাস যায় এবং পেটে ব্যথা ও কামড়ানি অনুভূতিও থাকে।
যখন রোগটি মারাত্মক ভাবে প্রকাশ পায় তখন খাওয়ায় অরুচি, শারীরিক দুর্বলতা, ক্লান্তিবোধ, দেহের ওজন কমে যাওয়া ও পেটে ব্যথা হয় এবং রোগীর চেহারা বিমর্ষ, জ্বর, হার্টবিট বেড়ে যায় ও পেট প্রদাহ জনিত কারণে শক্ত ও ব্যথাময় হয়ে যায়।
আলসারেটিভ কোলাইটিস হতে যেসব জটিলতা দেখা দিতে পারেঃ
১) Life-threatening colonic inflammation বা প্রাণ সংহারী কোলনের প্রদাহ-
কোলন প্রসারিত হয়ে টক্সিক মেগাকোলন হতে পারে এবং যাতে ব্যাকটেরিয়া থেকে নির্গত বিষাক্ত পদার্থ পোর্টাল এবং সিস্টেমিক সার্কুলেশন এ চলে যায় — এতে সারা দেহে ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে যাকে সেপটিসেমিয়া বলে।
এমতাবস্থায় প্রতিদিন পেটের এক্সরে করে ফলোআপ করা হয়, যদি কোলন সম্প্রসারিত হয়ে ৬ সেন্টিমিটারের বেশি হয় তখন কোলোনিক পারফোরেশন বা কোলন ফুটো হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।
যদি কোলনে এমনতরো প্রদাহ দেখা দেয় এবং একইসাথে টক্সিক মেগাকোলন থাকে তাহলে একে সার্জিক্যাল ইমারজেন্সি বলে এবং তৎক্ষণাৎ ইমারজেন্সি কোলেকটমি বা পুরো বৃহদান্ত্র কেটে ফেলতে হয়।
২) রক্তপাত হওয়া
প্রদাহ যদি বড় কোন ধমনিকে আক্রান্ত করে তাহলে প্রচুর রক্তপাত হতে পারে।
৩) ক্যান্সার
আলসারেটিভ কোলাইটিস হতে কোলরেকটাল ক্যান্সারের কারণে প্রতি ৬ জনের মধ্যে ১ জনের মৃত্যু হতে পারে।
অনিয়ন্ত্রিত প্রদাহ যদি বিস্তৃত ও দীর্ঘ মেয়াদি হয় তাহলে ডিসপ্লাশিয়া ও ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
এভাবে যেসব রোগীর দীর্ঘমেয়াদী ও বিস্তৃত প্রদাহ রয়েছে তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন।
৪) পরিপাক তন্ত্র ব্যাতীত অন্যান্য অঙ্গে জটিলতা –
প্রাইমারি স্ক্লেরোজিং কোলেন্জাইটিস, কোলান্জিওকারসিনোমা।
ইনভেস্টিগেশন বা পরীক্ষা নিরীক্ষাঃ
পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয় সাধারণত –
* রোগ নিশ্চিত করতে
* রোগের বিস্তৃতি দেখতে
* রোগের সক্রিয়তা দেখতে
* জটিলতা চিহ্নিত করতে
★ CBC – অ্যানেমিয়া বা রক্ত স্বল্পতা দেখা দিতে পারে (রক্ত পাতের কারণে, আয়রন ফোলিক অ্যাসিড কিংবা ভিটামিন বি১২ শোষণে সমস্যার কারণে)
★ প্লাটিলেট কাউন্ট – বেড়ে যেতে পারে দীর্ঘ মেয়াদি প্রদাহের কারণে
★ S. Albumin – কমে যায় (প্রোটিন লুজিং এন্টেরোপ্যাথি, প্রদাহ জনিত রোগ কিংবা পুষ্টিহীনতার কারণে)
★ ESR and CRP – বেড়ে যায় রোগের সক্রিয়তা এবং অ্যাবসেস তৈরির কারণে
★ Faecal calprotectin – পরিপাক তন্ত্রের প্রদাহ জনিত রোগ নির্ণয়ে এটি একটি উচ্চ সংবেদনশীল পরীক্ষা, এমনকি CRP স্বাভাবিক থাকা অবস্থায়ও এটি বাড়তে পারে।
এটি বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ IBD থেকে IBS পৃথককরণে এবং IBD রোগের সক্রিয়তা মনিটর করতে।
★ Stool Microscopy and Culture – RBC, Cl difficile toxin, ovs & cysts
★ Blood culture and Serological tests
★ Colonoscopy – ডায়েরিয়া এবং সেই সাথে যদি ESR কিংবা CRP বেশি থাকে অথবা আশংকা জনক অবস্থা তৈরি হয় (দেহের ওজন কমে যাওয়া, পায়ুপথে রক্তপাত এবং রক্ত স্বল্পতা)
আলসারেটিভ কোলাইটিসে আলসার থাকুক কিংবা না-ই থাকুক শিরা উপশিরাগুলো নষ্ট হয়ে যায়, গ্রানুলারিটি, মিউকাস আবরণী ভঙ্গুর হয়ে যায় এবং স্পর্শে রক্তপাত হয়ে থাকে। বায়োপসি নিয়ে রোগ নির্ণয় নিশ্চিত করা হয়, রোগের বিস্তৃতি দেখা হয় এবং দীর্ঘ মেয়াদি রোগের ক্ষেত্রে ডিসপ্লাসিয়া বা ক্যান্সারের আবির্ভাব ঘটছে কি-না সেটা দেখা হয়।
★ রেডিওলজি
পেটের এক্স-রে করে কোলনের সম্প্রসারণ, মিউকোসাল ইডিমা (থাম্ব প্রিন্টিং কিংবা পারফোরেশন বা কোলন ফুটো হয়ে গিয়েছে কি-না সেটা দেখা হয়।
যাদের প্রক্টাইটিস রয়েছে তাদের প্রক্সিমাল ফিকাল লোডিং বা কোলনে পায়খানা আটকে আছে দেখা যায়।
সিটি স্ক্যান – কোন জটিলতা ফুটো হয়ে যাওয়া কিংবা অ্যাবসেস দেখা হয়।
চিকিৎসাঃ
১) মেডিক্যাল থেরাপি –
মূলত মেডিকেল থেরাপি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তদুপরি যথাযথ চিকিৎসা পেতে মেডিসিন, সার্জারি, রেডিওলজিস্ট, নার্স এবং ডায়েটিশিয়ানের সমন্বিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত কার্যকরী হিসেবে পরিগনিত। আলসারেটিভ কোলাইটিস হলো আজীবনের রোগ তাই এই রোগ সম্পর্কে জানা, আশ্বস্ত হওয়া এবং যথাযথ চিকিৎসা নেওয়া রোগীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ –
★ একিউট অ্যাটাকের চিকিৎসা করা
★ পুনরুৎপত্তি প্রতিরোধ করা
★ কোলনের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া প্রতিরোধ করা
★ ডিসপ্লাশিয়া নির্ণয় করা এবং ক্যান্সার প্রতিরোধ করা
★ সার্জারির প্রয়োজন পড়লে উপযুক্ত রোগী নির্বাচন করা।
ক) নন-বায়োলজিক থেরাপি
১) অ্যামাইনোস্যালিসাইলেট
* মেস্যালাজিন
* ওস্যালাজিন
* সালফাস্যালাজিন
* ব্যালস্যালাজাইড
২) গ্লুকোকর্টিকয়েড
* প্রেডনিসোলোন
* হাইড্রোকর্টিসোন
* বুডিসোনাইড
* বেক্লোমিথাসোন
* মিথাইলপ্রেডনিসোলোন
৩) অ্যান্টি-মেটাবোলাইট
* অ্যাজাথায়োপ্রিন
* মারকেপ্টোপিউরিন
* মেথোট্রেক্সেট
৪) ক্যালসিনিউরিন ইনহিবিটর
* সাইক্লোস্পোরিন
৫) অ্যান্টিবায়োটিক
* সিপ্রোফ্লক্সাসিন
* মেট্রোনিডাজোল
খ) বায়োলজিক থেরাপি
১) অ্যান্টি-TNF অ্যান্টিবডি
* ইনফ্লিক্সিম্যাব
* অ্যাডালিমুম্যাব
* গোলিমুম্যাব
* সার্টোলিজুম্যাব
২) অ্যান্টি-আলফা4বিটা7 ইন্টেগ্রিন
* ভেডালিজুম্যাব
৩) জ্যানাস কাইনেজ ইনহিবিটর
* টোফাসিটিনিব
৪) অ্যান্টি-পি40 অ্যান্টিবডি
* উস্তেকিনুম্যাব
ডাঃ এম সাঈদুল হক
সহকারী অধ্যাপক, লিভার বিভাগ,
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
চীফ কনসালট্যান্ট, ঢাকা গ্যাস্ট্রো-লিভার সেন্টার।
০১৭০৩-৭২৮৬০১, ০১৭১০-০৩২১৫৮
০১৯২৭-০৬৮১৩৬, ০১৮৬৫-৫০৪০২৬
All reactions:
206206